জামিয়া দারুসসালাম প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

ঐতিহ্য লালিত বিদ্যাপীঠ “জামিয়া ইসলামিয়া দারুসসালাম ভাটপাড়া” মানেই এক জীবন্ত ইতিহাস। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এ জামিয়ার কীর্তিকলাপ। এ প্রতিষ্ঠানের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে শত-সহস্র হিস্ট্রোরি। রচিত হয়েছে তারিখের নানান অধ্যায়। ঐতিহাসিক এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার পেছনের ইতিহাসও কম চমকপ্রদ নয়!
৬০ দশকের কথা! তৎকালিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার পশ্চিমাঞ্চল রাজঘর-ভাটপাড়ায় দুনিয়া বৈরাগী এক খোদাভীরু বাস করতেন। জগতজুড়ে আলোকিত এ মনীষার নাম মাও. আব্দুস সালাম রহ.। পাহাড়পুরের অলিকুল শীরমণির পরিবারে জন্ম যার। তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর এ অজাপাড়া গাঁয়ের বেনামাজী মানুষগুলোর পেছনে মেহনত করে অধিকাংশকে নামাজীদের কাতারে শামিল করেন। বিখ্যাত দুটি গ্রামের ইমাম হওয়ায় তাঁকে অনেকেই তাদের গৃহে দাওয়াত করে খাওয়াতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করতো। ইবাদাত গুজার এ বান্দা যে কোন বে-নামাজীর ঘরে মেহমান হতেন না। তাই তারা পুরো ১ সপ্তাহ তাঁর মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করার পর তাঁকে তাদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ জানাতে সাহস করতো।
তিনি প্রায়শই ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. এর সাথে এ গ্রামের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন। ফখরে বাঙ্গাল রহ. তাঁকে এ এলাকায় একটি দ্বীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার পরামর্শ দেন । তাই তিনি ১৯৭০ সালে ভাটপাড়ায় একটি মাদ্রাসা ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু বিধিবাম! এক বছর যেতে না যেতেই দেশে শুরু হয়ে গেলে মুক্তিযুদ্ধ। ফলে মাদ্রাসার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলো। ক’দিন পর দেশ স্বাধীন হলো। এভাবেই কেটে যায় প্রায় ৪ টি বছর। মাদ্রাসা বন্ধের ঘটনায় মাও. আব্দুস সালাম সাহেব রহ. মারাত্মক মনোক্ষুণ্ণ ও আশাহত হন। কারণ তিনি মনে করতেন এ প্রতিষ্ঠান অত্র অঞ্চলের মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে এবং সর্বোপরি তাদের স্বাবলম্বিতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হবে।
অতঃপর ১৯৭৪ সালে মাওলানা ইসহাক সাহেব দা. বা. ( বর্তমান মুহতামিম, রাজঘর-থলিয়ারা মহিলা মাদ্রাসা) ভাটপাড়ায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে পরামর্শ দিতে অলিকুল শিরোমণি মাও. আব্দুস সালাম সাহেব রহ. এর কাছে যান এবং দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে তিনি দরসি সকল কিতাব পড়ানোর দায়িত্ব নেন। তারপর মাও. আব্দুস সালাম সাহেব রহ. তাঁর কাছে পেছনে ফেলে আসা স্মৃতিময় কাহিনী রোমন্থন করে বলেন , “আমি ফখরে বাঙ্গাল রহ.’র পরামর্শে ভাটপাড়ায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম কিন্তু দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং চলুন পূর্বোক্ত মাদ্রাসাটি পুনরায় চালু করি”। তখন ছিলো রমযান মাস। বাদ ফজর ভাটপাড়া মসজিদ কমিটির তৎকালীন সেক্রেটারি হাজী আয়াত আলী সাহেবকে তিনি মসজিদে ডেকে আনেন। এবং এ বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত হন। তারপর তাঁদেরকে উৎসাহ, উদ্দীপনা আর অগ্রগামী হতে সঙ্গ দেন মসজিদ কমিটির তৎকালীন সভাপতি হাজী মস্তু মিয়া বড় সরদার।
মাও. আব্দুস সালাম সাহেব রহ. এর নেতৃত্বে একদল হিতাকাংখী জনপ্রতিনিধি, যার মধ্যে ‘বড় সরদার’ খ্যাত হাজী মস্তু মিয়া ও হাজী আয়াত আলী সাহেবদ্বয় অন্যতম, জামিয়া ইউনুছিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান এবং উলামায়ে কেরামের সাথে বিষয়টি আলোচনা করেন। তারপর রইসুল মুফাসসিরিন আল্লামা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর রহ. মাওলানা মতিউর রহমান রহ. ও মুফতিয়ে আযম মুফতি নুরুল্লাহ সাহেব রহ. সম্মিলিতভাবে মাদ্রাসার নামকরণ করেন “ভাটপাড়া দারুসসালাম ইসলামিয়া মাদ্রাসা”। অতপর মাও. আব্দুস সালাম সাহেব রহ. , মাও. ইসহাক সাহেব দা. বা. ও মাও. কারী সিদ্দিকুর রহমান রহ. সাহেবত্রয় মিলে প্রায় ১৪/১৫ জন ছাত্র নিয়ে পূনরোদ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের যাত্রা করেন। যা অদ্যবধি বহমান। সেই ১৫ জন ছাত্রের অধিকাংশই দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে অধ্যাপনা করছেন। তাদের অন্যতম হল:

অল্প ক’দিনেই এর সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের শহর-বন্দর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। দফায় দফায় এগুতে থাকে শ্রেণী বর্ধিতকরণ এবং উন্নীত হতে থাকে মাদ্রাসার অবকাঠামো। এলাকাবাসী অবলোকন করে তার উত্তরোত্তর সফলতার রাজপথ।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে কওমি অঙ্গনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অথরিটি ফযিলত-২য় বর্ষ ( স্নাতক ডিগ্রি) চালু হওয়ার দরূন মাদ্রাসাটি জামিয়া ( বিশ্ববিদ্যালয়) নামে রুপান্তরিত হয়। তাই জামিয়া ইউনুছিয়ার সাম্প্রতিক মুহতামিম আল্লামা মুফতি মুবারকুল্লাহ সাহেব দা. বা. এর পরামর্শে ও সকল আসাতেজায়ে কেরামের সাক্ষরিত রেজুলেশনের মাধ্যমে তার নতুন নাম করণ করা হয় ‘জামিয়া ইসলামিয়া দারুসসালাম ভাটপাড়া’ সদর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাংলাদেশ।
বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কিতাব বিভাগের অধীনে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করা “ভাটপাড়া দারুসসালাম ইসলামিয়া মাদ্রাসা ” প্রতিষ্ঠার বীজ বপন হয়েছিলো এভাবে । যা এ অঞ্চলের জনগণের আশা ও চাওয়া-পাওয়ার বাস্তব প্রতিফলন। ইনশাআল্লাহ এর সাফল্যের স্রোত ধারা কেয়ামত পযর্ন্ত কায়েম থাকবে।